শিক্ষকতার অবসর নয় দুঃস্বপ্ন: হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন হোক

লেখক: Π আতাউর রহমান
প্রকাশ: ১ সপ্তাহ আগে

বাংলাদেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা মানেই আত্মত্যাগ, নীরব অধ্যবসায় এবং সমাজসেবার এক অনন্য মিশেল। যদিও এমপিও (মাসিক বেতন আদেশ) সুবিধাভোগী শিক্ষকরা সরকারের আর্থিক সহায়তা পান, তবুও তাদের অনেক মৌলিক রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা অধরা রয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো—অবসরকালীন প্রাপ্য অর্থ নিয়ে জটিলতা, যা তাঁদের শেষ জীবনকে করে তুলছে এক দুঃসহ দুঃস্বপ্ন।

● হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়

সম্প্রতি হাইকোর্ট স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন—বেসরকারি এমপিওভুক্ত পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারীকে অবসরের ছয় মাসের মধ্যেই অবসরভাতা প্রদান করতে হবে। বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজি জিনাত হকের দ্বৈত বেঞ্চের ১৩ পৃষ্ঠার রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।

আদালত মন্তব্য করেছেন—“শিক্ষকরা অবসরকালীন সুবিধা পেতে বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান। একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কতটুকু বেতন পান, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। অবসরভাতার জন্য এমন ভোগান্তি চলতে পারে না।”

 

এই রায়ের মাধ্যমে আদালত কেবল প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়, বরং মানবিক ব্যর্থতাকেও তুলে ধরেছেন।

● বাস্তবতা: অসীম ভোগান্তি

আজও দেখা যায়, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা অবসর নেওয়ার তিন থেকে চার বছর পরও প্রাপ্য অর্থ পান না। এর ফলে অনেকেই চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে পারেন না, সন্তানের বিয়ে দিতে বা ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতেও অক্ষম হয়ে পড়েন। কেউ কেউ অর্থাভাবে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করছেন—যা একটি সভ্য রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক।

অবসরের জীবনকে আরও জটিল করেছে বেতনের ১০% হারে কল্যাণ তহবিলে কর্তন। শুরুতে এই হার ছিল ৬%, কিন্তু কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়াই তা বাড়ানো হয়েছে। অথচ বাড়তি কর্তনের বিপরীতে সুবিধা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগই আজও দৃশ্যমান নয়।

● ২০১৯ সালের রায়ও উপেক্ষিত

২০১৯ সালে হাইকোর্ট (মামলা নং ১৩১১৮/২০১৯) নির্দেশ দিয়েছিলেন—
১. অবসরের ছয় মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ পাওনা পরিশোধ করতে হবে।
২. অতিরিক্ত ৪% কর্তনের বিপরীতে আনুপাতিক সুবিধা দিতে হবে।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই রায়ও বাস্তবায়ন হয়নি। এর মানে কেবল আইন অমান্য করা নয়, শিক্ষকদের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতারও প্রতীক।

● জোরালো দাবি ও করণীয়

রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারকদের কাছে আজ জরুরি কিছু দাবি—
১. হাইকোর্টের সর্বশেষ রায় দ্রুত বাস্তবায়ন।
২. অবসরের ছয় মাসের মধ্যেই অবসরভাতা প্রদানের নিশ্চয়তা।
৩. অতিরিক্ত কর্তনের বিপরীতে আনুপাতিক সুবিধা।
৪. সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা।
৫. শিক্ষক-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা ভাতা।

● রাষ্ট্রের দায়িত্ব: মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া

আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার নেপথ্য যোদ্ধারা যেন তাঁদের শেষ জীবন স্বস্তি ও মর্যাদায় কাটাতে পারেন—এটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। শিক্ষক সমাজকে অবমূল্যায়ন করে কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না।

এখনই সময়—হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের পরিচয় দেওয়ার।

লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও সমাজচিন্তক ; প্রাক্তন সভাপতি, বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব।

error: Content is protected !!